Sunday, November 29, 2015

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দায় কি সরকারের একার?


আফরিনা হক::

পাবর্ত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ সিং বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি সংসদে সরকারি দলের সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইনের এক প্রশ্নের জবাবে আরো বলেন, শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকার গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর এই চুক্তি স্বারিত হয়। চুক্তিটি ৪টি খণ্ডে বিভক্ত ‘ক’ খন্ডে ৪টি, ‘খ’ খন্ডে
৩৫টি, ‘গ’ খন্ডে ১৪টি এবং ‘ঘ’ খন্ডে ১৯টিসহ মোট ৭২টি ধারা রয়েছে। তিনি বলেন, তিন পার্বত্য জেলায় হস্তান্তরযোগ্য ৩৩টি বিষয়/বিভাগের মধ্যে এ পর্যন্ত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে ২৯টি, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে ২৯টি এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে ২৮টি বিষয়ে/দফতর হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া বাস্তবায়িত ধারাসমূহ দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা বলেন, চুক্তির বেশিরভাগ বিষয়ই বাস্তবায়ন হয়েছে। চুক্তিতে ৭২টি শর্ত আছে, তার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। আর ১৫টি আংশিকভাবে হয়েছে এবং ৯টি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আশাকরা হচ্ছে বাকী ধারাগুলোও শিঘ্রই বাস্তবায়ন হবে। এর পরও পাহাড়ী সন্ত্রাসী, আঞ্চলিক সংগঠনের নেতা ও কতিপয় বুদ্ধিজীবী ক্রমাগত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য সরকারকে অভিযুক্ত করে যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দায় কি সরকারের একার? দুইপক্ষ একটি চুক্তি করেছে, একপক্ষ দাবী করছে তারা ৯৮ভাগ চুক্তি বাস্তবায়ন করে ফেলেছে? কিন্তু অপরপক্ষ? চুক্তিতে বলা হয়েছে, পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা অস্ত্র সমর্পন করবে, সন্ত্রাস ও অপরাধের রাস্তা ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে? কিন্তু আজ আমরা কি দেখছি? খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধের স্বর্গরাজ্য আজো পার্বত্য চট্টগ্রাম। শুধু তাই নয়, এখনো বাংলাদেশ ভেঙে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার হুমকি সন্ত্রাসীদের মুখে মুখে। সেজন্য সংগ্রহ করা হয়েছে ভয়ানক সব যুদ্ধাস্ত্র। পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের পক্ষে সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমগুলো সরকারকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য যতোবার বলে তার বিপরীতে একবারও পাহাড়ীদেরকে বলে না শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে তোমরা কি করেছো? তোমাদের  হাতে কেন এখনো এমন ভয়ানক মারণাস্ত্র, গায়ে কেন সামরিক পোষাক ও সরঞ্জাম? কেন এখনো কণ্ঠে বিচ্ছিন্নতাবাদের হুমকি? সরকার কেন একতরফা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করবে?

পাহাড়-উপত্যকা পরিবিষ্ট বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিশাল এলাকা জুড়ে তিনটি জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ অঞ্চল বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ এলাকার জনসংখ্যা ১৫,৯৮,২৯১ জন। এদের মধ্যে ৫ লক্ষ মানুষ ১৪ টি নৃগোষ্ঠীর যারা সাইনো, তিব্বত, মঙ্গেলীয়া, চীনা, আরাকান, ত্রিপুরা, বার্মা অন্যান্য পাহাড়ী অঞ্চল থেকে অল্প কিছু বছর পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে আবাস স্থাপন করেছে। অর্থাৎ তারা আদিবাসী নয় বরং অভিবাসী।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ১৫৫০ সালের দিকে প্রণীত বাংলার প্রথম মানচিত্রে বিদ্যমান ছিল। তবে এর প্রায় ৬০০ বছর আগে ৯৫৩ সালে আরাকানের রাজা এই অঞ্চল অধিকার করেন। ১২৪০ সালের দিকে ত্রিপুরার রাজা এই এলাকা দখল করেন। ১৫৭৫ সালে আরাকানের রাজা এই এলাকা পুনর্দখল করেন, এবং ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত অধিকারে রাখেন। মুঘল সাম্রাজ্য ১৬৬৬ হতে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত এলাকাটি সুবা বাংলার অধীনে শাসন করে। ১৭৬০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই এলাকা নিজেদের আয়ত্বে নেয়। ১৮৬০ সালে এটি ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসাবে যুক্ত হয়। ব্রিটিশরা এই এলাকার নাম দেয় চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস বা পার্বত্য চট্টগ্রাম। এটি চট্টগ্রাম জেলার অংশ হিসাবে বাংলা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। ১৯৪৭ সালে এই এলাকা পূর্ব পাকিস্তানের এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটি বাংলাদেশের জেলা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮০ এর দশকের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি জেলা – রাঙামাটি, বান্দরবান, ও খাগড়াছড়িতে বিভক্ত করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শান্তিবাহিনী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছিল অসংখ্য নিরীহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হবার পর কিছু ভাঙ্গা ও পুরাতন অস্ত্র শান্তিবাহিনীর সদস্যরা জমা দিয়ে সাধারণ ক্ষমা ও পুনর্বাসনের রাষ্ট্রিয় সুবিধা গ্রহণ করে। কিন্তু যে শান্তির অণ্বেষায় শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল তা আজো অধরা রয়ে গেছে। এর প্রধান কারণ পাহাড় এখনো অবৈধ অস্ত্রমুক্ত নয়। ভাঙা ও পুরাতন কিছু অস্ত্র জমা দিলেও পাহাড়ী সন্ত্রাসী নতুন করে আরো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সংগ্রহ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও একই ধরনের সন্ত্রাসী-কার্যক্রম ইউপিডিএফ, জেএসএস এবং সংস্কারবাদী দলের লোকেরা সবাই মিলে করে যাচ্ছে। জেএসএস, ইউপিডিএফ এবং সংস্কারবাদী নামে গড়ে ওঠা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মানুষদের কাছ থেকে নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে জোর জবরদস্তি করে চাঁদা আদায় করে যাচ্ছে। আদায় করা চাঁদা দিয়ে আবারও আধুনিক অস্ত্র কিনে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর শান্তি প্রিয় পার্বত্যবাসীর প্রত্যাশা ছিল সবুজ পাহাড়ে আর অস্ত্রের ঝনঝনানি হবে না, প্রাণহানি ঘটবে না। বাড়িঘর, সহায় সম্পত্তি আগুনে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে না। ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান নিতে হবে না। কিন্তু তা যেন অধরাই রয়ে গেল। পাহাড়ের কোথায় কখন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা কার ওপর হামলে পড়বে তা নিয়ে সর্বক্ষণিক উৎকণ্ঠায় থাকতে হচ্ছে পাহাড়ী-বাঙালী শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে। শান্তি চুক্তির দীর্ঘ সময় পরও পাহাড় অশান্তই থেকে গেল, এর পেছনে কী রহস্য রয়েছে তা পার্বত্যবাসীর মনে অজানাই রয়ে গেল।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশ সরকার ও জনসংহতি সমিতির সঙ্গে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় মূলত তখন থেকেই নতুন ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা রচিত হয়। মহলবিশেষ নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও তাদের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য পাহাড়ে সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি’তে পাহাড়ি নেতারা নিজেদের উপজাতি হিসেবে মেনে নিলেও এখন আদিবাসী স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারতের ১২৯ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্তের মধ্যে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা অংশে রয়েছে ৪৭ কিলোমিটার। এই সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে বিজিবির কোনো নজরদারী না থাকায় দুই দেশের সন্ত্রাসী, পাচারকারীসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধচক্র এই এলাকাকে অপরাধের স্বর্গরাজ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। এই এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অস্ত্রের যোগান পাচ্ছে অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে আসা চোরাচালানের মাধ্যমে। বাংলাদেশের এই গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চলটি রক্ষার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন প্রয়োজন- যা পাহাড়ি সন্ত্রাসী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বাঁধার কারণে সম্ভব হচ্ছেনা। প্রতিনিয়ত যৌথবাহিনী সীমান্ত এলাকা থেকে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গুলি, সামরিক পোশাক ও সামরিক সরঞ্জাম আটক করেছে।

গত সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখের পার্বত্যনিউজের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। এবারে ঘটনাস্থল খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা থানা। এ অপারেশনে  আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে ভারী মেশিনগান, গ্রেনেড, এসএলআর, ৫.৫৬ এমএম এসএমজি, ৭.৬২ ফোল্ডেড এসএমজি মতো ভয়ানক মারণাস্ত্র রয়েছে। একইভাবে গত ১৫ আগস্ট বাঘাইছড়িতে আরেকটি অপারেশনে পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র ও গোলাবারুদ। এসময় সেনাবাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে ৫জন উপজাতীয় সন্ত্রাসী মারা যায় যাদের প্রত্যেকের পরণে ছিল সামরিক পোশাক। শান্তিবাহিনী সৃষ্টির পর থেকে সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে এতো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা অতীতে আর কখনো ঘটেনি। ভয়ানক যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে এদের কাছে সব সময়ই সামরিক পোশাক পাওয়া যায়। আগে এ ধরনের পোশাক সন্ত্রাসীদের শরীরে দেখা যায়নি। অস্ত্র হাতে নেয়ার পর নতুন ইউনিফর্ম প্রমাণ করছে এরা ইতোপূর্বেকার চেয়ে বহু গুণে সংঘবদ্ধ এবং সংগঠিত।

শান্তিচুক্তির পর আত্মসমর্পণের সময় পরিলক্ষিত হয়েছিল, শান্তি বাহিনীর বহু সদস্য ওই দিন যেমন অনুপস্থিত ছিল। তেমনি তাদের হাতে থেকে যায় ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদও। এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে বিলুপ্ত শান্তি বাহিনীর সদস্যরা পাহাড়জুড়ে চাঁদাবাজি করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এখন আবার এরা ইউনিফর্ম পরিধান করছে।আবার গত ৬ সেপ্টেম্বর বান্দরবানে রাইফেল, পিস্তল ও বিপুল পরিমাণ গুলিসহ পার্বত্য জনসংহতি সমিতির চাঁদাবাজ আটক করে যৌথবাহিনী। আটককালে তাদের কাছ থেকে রাইফেল সহ টাকা নগদ টাকাও উদ্ধার করে।

সবচেয়ে ভয়ংকর যেটি তা হচ্ছে, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, অনেক সরকারী কমকর্তাদের চাঁদা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরী করতে হয়।  তাদের গায়ে  পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা হাত তুললে বাংলাদেশ সরকার একটি মামলা করার সাহস পর্যন্ত দেখায় না। বরং প্রতিবাদকারীদের নামে মামলা হয়। বাংলাদেশের মানুষের চাঁদার টাকায় চলছে স্বাধীন জুম্মল্যাণ্ড প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।  বিপুল পরিমাণ চাঁদা আয়ের কারণে তারা এতাটাই বেপরোয়া যে চাঁদা না দিলে হুমকি, অপহরণ ও খুনের মতো ঘটনা ঘটাতে পাহাড়ী সংগঠনগুলো এতোটুকু দ্বিধা করে না।  একবার অপহরণ করা হলে দাবী করা হয় বিপুল পরিমাণ মুক্তিপণের টাকা। পাহাড়ে কোন লোককে গাছের ব্যবসা করতে হলে তাকে চাঁদা দিতে হয়।একই সঙ্গে ব্যবসায়ীর নিরাপত্তার জন্য দিতে হয় টাকা। সড়ক পথে চলাচলকৃত বিভিন্ন যানবাহন, হাট বাজারে বাজারজাতকৃত পণ্যে, মৎস্য ব্যাবসায়ীদের ওপর, ঠিকাদারদের ওপর, বাঁশ ও বেত জাতীয় সম্পদের ওপর, কৃষি জমি এবং বাগান সহ বিভিন্ন বিষয় থেকে বার্ষিক প্রায় ৪০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজির মাধ্যমে আয় করে থাকে পার্বত্য সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো।  নেতাদের পকেট ভারী, অস্ত্র কেনা ও সংগঠনের ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি এই চাঁদার একটি বড় অংশ ব্যয় হয় পাহাড়ী সংগঠনগুলোর পক্ষের বুদ্ধিজীবী, ও গণমাধ্যম পরিপালনে। যেকোনো ইস্যুতে পাহাড়ীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের পাহাড়ে নিয়ে আসতে এই টাকা ব্যয় করে থাকে।  ঢাকায় নানা সেমিনার, কর্মসূচীতেও দেয়া হয় এই চাঁদার টাকা।  শুধু বাঙালী নয়, পাহাড়ীরাও এই চাঁদাবাজীর কবল থেকে মুক্ত নয়।  চাঁদা দিয়ে পাহাড়ে বসবাস যেন এখানকার অলিখিত আইন। চাঁদা না দিয়ে পার পাওয়ার কোনো উপায় নেই।  তাই জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে চাঁদাবাজী মুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু পাহাড়ী সন্ত্রাসী নয়, দূর্গম সীমান্তের সুযোগ নিয়ে বিদেশী বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও অবস্থান করে। বিশেষ করে সাতবোন রাজ্য ও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিভিন্ন তৎপরতা মাঝে মধ্যেই খবরে আসে। সম্প্রতি বান্দরবানের দুর্গম এলাকাগুলোতে বিজিবির সঙ্গে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের মধ্যে দীর্ঘ সময় গুলি বিনিময় হয়। সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পে বিজিবির টহল দলের উপর অতর্কিত গুলি ছোড়ে, বিজিবিও পাল্টা গুলি চালায়। খণ্ডকালীন হলেও এই যুদ্ধে সেনাবাহিনী, যুদ্ধ হেলিকপ্টার ও জঙ্গী বিমান ব্যবহার করতে হয়। জানা যায়, বান্দরবানের ওই এলাকাটি এতোই দুর্গম যে ৪৩৯ কিলোমিটার এলাকায় কিছু পাহাড়ী বসবাস করলেও সরকারিভাবে কোনো স্থাপনা নেই। ৫৩৯ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার মধ্য গতবছর এক বছরে মাত্র ১০০ কিলোমিটার এলাকায় বিজিবি তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। বাকী সীমান্ত অরক্ষিত।

মাতৃভূমি বাংলাদেশকে রক্ষার এই আপ্রাণ চেষ্টা কিছু সংখ্যক নামধারী বুদ্ধিজীবীর অযাচিত আস্ফালনের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ আদিবাসী স্বীকৃতি দেয়া হলে মানতে হবে জাতিসংঘের ‘আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণের ঘোষণাপত্র’ এবং সেই অনুযায়ী বাস্তবায়ন ও করতে হবে। এই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী আদিবাসীদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার তৈরি হবে। পাহাড়ের সমূদয় প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের মালিকানা আদিবাসীদের হবে সরকারের নয়। পাহাড়ে আর কখনোই আদিবাসীদের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষীবাহিনী প্রবেশ করতে পারবে না এবং আদিবাসী অঞ্চল সীমান্ত সংলগ্ন হলে, সীমান্তের ওপারে নিজেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যোগাযোগ ও বিভিন্ন সহযোগিতা স্থাপন করতে পারবে। দেশের সেনাবাহিনীকে প্রতিরক্ষার কোনো কাজে নিয়োজিত করতে হলে অবশ্যই আদিবাসীদের অনুমতির দরকার হবে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এসব শর্ত ছাড়াও আরও বেশ কিছু শর্ত এই ঘোষণাপত্রে রয়েছে যা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে পাহাড়ি নেতারা এই ‘আদিবাসী স্বীকৃতি’র পেছনে দৌড়াচ্ছে ক্ষমতার লোভেই। জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্র মেনে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেওয়া। যে সকল বুদ্ধিজীবী এসব উপজাতির পক্ষে কথা বলে যাচ্ছেন তারা কি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ধংস চান ? আসলে এক্ষেত্রে উভয়পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে দেশকে রক্ষায়।

নৃগোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতার কারণেই বারংবার ভূমিবিরোধের সুরাহা করা যায়নি। এইখানে বাঙালি-নৃগোষ্ঠী সকলকে সাংবিধানিক নিয়মের আওতায় আসতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সকলের সমতাভিত্তিক সততা ও ত্যাগের মনোভাব, সর্বোপরি-শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্তরিক ইচ্ছা। এই সমস্যার সমাধানে বাঙালি-নৃগোষ্ঠী সকলকে নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পকে জলাঞ্জলি দিতে হবে। পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীকে বুঝতে হবে, অনেক বিরোধিতা সত্ত্বেও শান্তিচুক্তিতে তাদের সকল ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার মেনে নিয়ে তৎকালীন সরকার সাহসের সাথে চুক্তি করেছিল পাহাড়ের প্রায় অর্ধেক বাঙালি জনগোষ্ঠী তথা ‘জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের অভিযোগ’ তুচ্ছ করে শুধুমাত্র শান্তি আনার লক্ষ্যে।

সীমান্তকে রক্ষা করতে দিঘীনালা উপজেলা বাবুছড়া এলাকায় নবগঠিত ৫১ বিজিবি’র সদর দপ্তর স্থাপনের কাজ শুরু হলে, স্থানীয় পাহাড়িরা শুরু থেকেই সেখানে বাঁধা দেয় । অপরদিকে বান্দরবানে বিজিবির সেক্টর কার্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের সরকারি অনুমোদন হলেও ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা ও পাহাড়ি সংগঠনগুলোর বিরোধীতার মুখে প্রক্রিয়াটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শহরের কাছে ময়নাতলী ব্রিজ এলাকার তারাছা মৌজায় বিজিবির সেক্টর কার্যালয়ের জন্য মন্ত্রণালয় ২৫ একর জায়গা অধিগ্রহণের অনুমোদন দেয়। কিন্তু ওই জমির অনেক অংশ বৌদ্ধ ধর্মগুরু উচহ্লা ভান্তে দাবি করায় এবং জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের বিরোধিতার মুখে সেক্টর কার্যালয় স্থাপন করা যায়নি। ফলে বান্দরবান সেক্টরের দাপ্তরিক কাজ চালাতে গিয়ে সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে বিজিবিকে।
বান্দরবান

বান্দরবানের রুমা থেকে আলীকদম পর্যন্ত প্রায় ১৪২ কিলোমিটার মায়ানমার সীমান্ত অরক্ষিত পড়ে রয়েছে। এছাড়া ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ৪৪ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ সীমান্তে থানচির বড় মদক ক্যাম্প ছাড়া অন্য কোনো ক্যাম্প না থাকায় পুরো সীমান্তই অরক্ষিত। এসব সীমান্ত দিয়ে মাদক পাচারের পাশাপাশি বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা, অস্ত্র ব্যবসা ও মায়ানমার থেকে লোকজনদের অবাধে যাতায়াত হয়ে আসছে। জেলা প্রশাসন তারাছা মৌজায় বিজিবির সেক্টর কার্যালয় স্থাপনের জন্য অনুমোদন দিলেও স্থানীয়রা বিরোধিতা করায় সেখান থেকে সরে আসে বিজিবি। পরে তারাছা মৌজার জায়গাটি সেক্টর কার্যালয়ের জন্য উপযোগী হওয়ায় সেখানে বিজিবি স্থাপনা নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করলে বাধা দেন বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা উচহ্লা ভান্তে ও তার শিষ্যরা। একই সঙ্গে জনসংহতি সমিতি ইউপিডিএফ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলোও বিরোধিতা করে। গহীন বন জঙ্গল-পাহাড় সমৃদ্ধ অত্যন্ত দূর্গম এলাকা হওয়ায় দূর থেকে গিয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে ব্যবস্থা নেয়াও সম্ভব হয় না। অথচ রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক রক্ষা, সীমান্ত ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস দমন এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এ অঞ্চলে নতুন বিজিবি ব্যাটালিয়ন স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই।

এভাবে সীমান্তে একের পর এক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় অস্ত্রের প্রকৃতি দেখে বোঝা যাচ্ছে শান্তিচুক্তির পর ভাঙ্গা অস্ত্র জমা দিলেও সন্ত্রাসীরা যে অস্ত্র ব্যবহার করে তা নিরাপত্তাবাহিনী ছাড়া আর কারো কাছে থাকে না। কেবল সেনাবাহিনীর পক্ষেই পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের হাতে থাকা যুদ্ধাস্ত্রের মোকাবেলা করা সম্ভব। হেলিকপ্টারগানশিপ কিম্বা যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করে দ্রুত আক্রমণ ও উদ্ধারকাজ পরিচালনা কেবল সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষেই সম্ভব। পাহাড়ী সন্ত্রাসী ও বিদেশী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবেলায় তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বশস্ত্র বাহিনীর অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের নামে মতলববাজরা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী অপসারণের যতোই দাবী তুলুক- তা জাতীয় নিরাপত্তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়। যতোদিন পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা পূর্ণাঙ্গভাবে অস্ত্র সমর্পন না করবে, বিচ্ছিন্নতাবাদের রাস্তা পরিত্যাগ করবে, যতোদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের আস্তানা থাকবে ততোদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান রাখতে হবে। বরং জাতীয় সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তায় সশস্ত্র বাহিনীকে যেখানে যেভাবে প্রয়োজন মোতায়েন করতে রাখতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জননিরাপত্তা রক্ষা সরকার ও সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক ও সর্বোচ্চ দায়িত্ব। সে লক্ষ্যে এই অস্ত্র উদ্ধার করতে এবং দেশের সীমান্ত রক্ষা করতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তে পর্যাপ্ত বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে। পাহারা আরো জোরদার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারো আপত্তি ও অজুহাত দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

আফরীনা হক : শিক্ষক ও সমাজকর্মী

No comments:

Post a Comment