অধ্যাপক সঞ্জয় হাজারিকা নয়াদিলি্লভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার সেন্টার ফর নর্থ-ইস্ট স্টাডিজ অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের পরিচালক হিসেবে ২০০৯ সাল থেকে এবং ম্যানেজিং ট্রাস্টি হিসেবে ২০০০ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোতে সাংবাদিকতা করেছেন। অধ্যাপক হাজারিকা নীতি বিশ্লেষক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবেও সুপরিচিত। এ ছাড়া তিনি সানডে গার্ডিয়ানের পরামর্শক সম্পাদক এবং ডাউন টু আর্থ ম্যাগাজিনের প্রকাশক সোসাইটি ফর ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশনের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান। সাক্ষাৎকার গ্রহণ: শেখ রোকন
সমকাল :আমরা জানি, আপনি উত্তর-পূর্ব ভারতের কেন্দ্রস্থল আসামের বাসিন্দা এবং বাংলাদেশেও অনেকবার এসেছেন। উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ নিয়ে আপনি অনেক দিন ধরে বিশ্লেষণ করছেন, গবেষণা করছেন। আপনার কাছে এই অঞ্চলের সীমান্তের দু'পাশের সম্পর্কের মূল্যায়ন জানতে চাই।
সঞ্জয় হাজারিকা :ঐতিহাসিকভাবে দুই অংশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দু'পাশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ একেবারে শূন্যে নেমে আসে। এর কারণ ভারত-পাকিস্তান বিভাগের তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে নিহিত। আপনি জানতে পারেন যে, সাতচলি্লশ সালের আগে আসামে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সম্পর্ক খুবই তিক্ত আকার ধারণ করেছিল। আসাম ভারতে যোগ দেয় এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে যোগ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান নাম ধারণ করে। মওলানা ভাসানী ছিলেন মূলত আসাম মুসলিম লীগের নেতা। দেশ ভাগের সময় তিনি পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। দুই পক্ষেরই নেতৃত্ব পর্যায়ে এসব তিক্ততা দেশ ভাগের পরও অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিস্থিতির অনেকখানি পরিবর্তন হয়। পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া বাংলাদেশি শরণার্থীদের কথা বেশি আলোচিত হয়; কিন্তু আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরার মানুষও অনেক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, স্বাগত জানিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এসব রাজ্যে অবস্থান করেছে, প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
সঞ্জয় হাজারিকা :হ্যাঁ, বিশেষ করে আশির দশকে এই অভিযোগ আসামের সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রবল হয়ে ওঠে, যা বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে অস্বীকার করা হয়েছে সবসময়ই। ওই সময় বিশেষ করে আসামে থাকা অনেক মানুষকে অবৈধ অভিবাসী আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর দাবি ওঠে। আমি এই ইস্যুতে সীমান্তের দুই পাশেই মাঠ পর্যায়ে সমীক্ষার কাজ করেছি, গবেষণা করেছি। আমি মনে করি, অবৈধ অনুপ্রবেশ বা অভিবাসনের অভিযোগ অসত্য নয়। কিন্তু আসামে যেভাবে বেশিসংখ্যক মানুষের অভিবাসনের কথা বলা হয়, সেটা সত্য নয়। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় কিছু মানুষের সবসময়ই সীমান্তের এপার-ওপার করাটা স্বাভাবিক। অনেক পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনও সীমান্তের দু'পাশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সমস্যা হচ্ছে, এই বাস্তবতা দুই পক্ষেই অনুধাবন করা হয়নি। এক পক্ষ সংখ্যাটাকে বড় করে দেখিয়েছে, অপর পক্ষ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। এখন সেই তিক্ত অতীতের অনেকখানি অবসান হয়েছে বলা যেতে পারে।
সমকাল :এই পরিবর্তনের কি কোনো মাইলফলক আছে? ঠিক কবে থেকে পরিবর্তনের সূচনা হলো?
সঞ্জয় হাজারিকা :আমি বলব, সেই সময়টা খুব বেশি আগের নয়, ২০০৯ সালের ডিসেম্বর। শেখ হাসিনা সরকার একটি ছক বদলে দেওয়া পদক্ষেপ নেয়। আগে থেকে অভিযোগ ছিল যে, উত্তর-পূর্ব ভারতে সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো সীমান্তের এপাশে আশ্রয় পায়। বাংলাদেশের পক্ষে এই অভিযোগও সবসময় অস্বীকার করে আসা হয়েছে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী সময়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী ৩-৪টি গোষ্ঠীর নেতাকে আটক করে ভারতের কাছে সোপর্দ করে বাংলাদেশ। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা ছিল বড় ধরনের পরিবর্তন। এর ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব পর্যায়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সরকারের ব্যাপারে একটি বড় ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।
সমকাল : দেশ বিভাগ, এমনকি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সমাজে, অর্থনীতিতে, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, আপনি জানেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে কতটা জানে?
সঞ্জয় হাজারিকা :সত্যি বলতে কি, এখনকার বাংলাদেশ সম্পর্কে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাধারণ মানুষ খুবই কম জানে। সীমান্তবর্তী লোকজনের হয়তো কিছুটা ধারণা থাকতে পারে। তবে বিরাট অঞ্চলটির বেশিরভাগ মানুষেরই বলা চলে কোনো ধারণা নেই। আমি নব্বই দশক থেকে আসছি। আমার চোখের সামনে বাংলাদেশ কত পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখানে একটি গতিশীল অর্থনীতি গড়ে উঠেছে, আপনাদের সক্রিয় সংবাদমাধ্যম রয়েছে, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো কত কাজ করছে! আমি প্রথম যখন আসি, একটা শুধু টিভি ছিল, বিটিভি। আপনাদের তো এখন কত টিভি চ্যানেল! এগুলো সম্পর্কে জানেই না। নেতৃস্থানীয় পর্যায় ছাড়া সাধারণ মানুষের ধারণাই নেই দারিদ্র্য বিমোচন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কত এগিয়ে গেছে!
সমকাল : উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক মহল কি জানে?
সঞ্জয় হাজারিকা :তারাও যতটা জানা দরকার, ততটা জানে না। তারা বাংলাদেশকে কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে দেখে। সেটাতেও আবার উত্তর-পূর্ব ভারতের নিজস্ব ভাষ্য আছে। যেমন আপনি দেখবেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে বিজেপির যে দলীয় অবস্থান ছিল, মোদি সরকার সেখান থেকে সরে এসেছে। তারা শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতে এসে কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব বা স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব আগের ভাষাতেই কথা বলে। অবৈধ অভিবাসীদের পুশব্যাক করতে চায়। এসব স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভোটের কথা মাথায় রেখে বলে তারা। আগামী বছর আসামে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। সেটা মাথায় রেখে হয়তো এ ধরনের কথাবার্তা আরও বাড়বে। নির্বাচনের পর আবার কমে যাবে। আরেকটি বিষয় বলব, মোদি সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু আসলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করা দরকার। দুই পাশে জনগণ পর্যায়ে যাতায়াত, যোগাযোগ ও বিনিময় বাড়া দরকার। বাংলাদেশ সম্পর্কে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাধারণ মানুষের যে 'মাইন্ডসেট' রয়েছে, সেখানে পরিবর্তন দরকার। তাহলে অন্যান্য পরিবর্তন সহজ হয়ে যাবে।
সমকাল :জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমগুলো কী কী হতে পারে?
সঞ্জয় হাজারিকা :সঙ্গীত হতে পারে, খেলাধুলা হতে পারে। আমি জানি, আসামের ভুপেন হাজারিকা বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। ভাটি আসামের সঙ্গে আপনাদের সঙ্গীত ও ভাষার অনেক মিল। কিন্তু এর পরে তরুণ আরও গায়ক উঠে এসেছে। তারা সারা ভারতে জনপ্রিয়, বাংলাসহ তিন-চারটি ভাষায় গান গায়। তাদের গান এখানে আসতে পারে। আপনাদের অনেক ব্যান্ড শিল্পী উত্তর-পূর্ব ভারতে জনপ্রিয়। যেমন মাকসুদুল হক তো অহমিয়া বংশোদ্ভূত। এ বছর জানুয়ারিতে গৌহাটিতে তার একটি কনসার্ট ছিল। আমি দেখেছি, কীভাবে তার কনসার্ট উপচে পড়েছিল। এ ছাড়া একই ধরনের ভাটিয়ালি ও ভাওয়াইয়া গান সীমান্তের দুই পাশেই জনপ্রিয়। এগুলো বিনিময় হতে পারে। উত্তর-পূর্ব ভারতে ফুটবল খেলা খুবই জনপ্রিয়। মেঘালয়ের একজন খেলোয়াড় এখন ব্রাজিলে খেলছে। শিলংয়ের দুটি ফুটবল ক্লাব গোটা ভারতে শীর্ষে। আপনাদেরও আবাহনী-মোহামেডান রয়েছে। তাদের মধ্যে খেলা আয়োজন হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার সাফ গেমস আছে; কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর আলাদা আয়োজন হতেই পারে। আপনাদের ক্রিকেট আন্তর্জাতিকভাবেই অনেক উন্নতি করেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে ক্রিকেটের ততটা উন্নতি হয়নি। এ ব্যাপারে বিনিময় হতে পারে। তাহলে জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগ ও বোঝাপড়া বাড়বে। বাংলাদেশ সম্পর্কে উত্তর-পূর্ব ভারতের মাইন্ডসেট পরিবর্তন সহজ হবে।
সমকাল :আমরা অনেক সময় শুনেছি, উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের সম্ভাবনাময় বাজার রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাণ গ্রুপ এক্ষেত্রে সাফল্য দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে সেই বাজার আসলে কতটা সম্ভাবনাময়?
সঞ্জয় হাজারিকা :প্রশ্ন হচ্ছে, কোন পণ্য? হ্যাঁ, প্রাণের কিছু পণ্য বেশ জনপ্রিয়। আমি শিলংয়ের রাস্তায় শিশুর হাতে প্রাণ জুসের প্যাকেট দেখেছি। সীমান্ত অঞ্চলের কিছু বাজারে মানুষকে চোরাচালানের মাধ্যমে যাওয়া বাংলাদেশি ওষুধ কিনতে দেখেছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আরও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা দরকার। একসময় বাংলাদেশি কসমেটিকসের চাহিদা ছিল। কিন্তু এখন উত্তর-পূর্ব ভারতে দেশীয় কসমেটিকস কোম্পানিগুলোর পণ্যে ছেয়ে গেছে। আসলে যেটা দরকার, তা হচ্ছে বিনিময়। কেবল একদিক থেকে গেলে হবে না। দুই পক্ষের মধ্যেই বিনিময় হতে হবে, বাণিজ্য ও ব্যবসার মাধ্যমে দুই পক্ষেরই লাভ হতে হবে। তাহলে সেটা টেকসই ও সম্প্রসারিত হবে। উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে তাজা ফল, প্রক্রিয়াজাত ফল আসতে পারে বাংলাদেশে। সীমান্তে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপিত হতে পারে।
সমকাল : বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদীগুলোর বেশিরভাগই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে। এসব নদীতে বাংলাদেশের অধিকার সম্পর্কে তারা কতটা সচেতন?
সঞ্জয় হাজারিকা :সাধারণ মানুষের কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। তবে যারা এসব বিষয়ে গবেষণা করেন, লেখালেখি করেন, তারা তো জানেনই।
সমকাল : এসব 'এনলাইটেনড' মানুষ কি অভিন্ন নদীতে বাংলাদেশের অধিকার সম্পর্কে সচেতন?
সঞ্জয় হাজারিকা :দেখুন, সবাই শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী। বেশিরভাগের কাছে ধুবড়ির পর ব্রহ্মপুত্র নদের কী হলো_ দেখার বিষয় নয়। কিন্তু এই চিত্রের পরিবর্তন হচ্ছে। যারা অভিন্ন নদীতে বাংলাদেশের অধিকার সম্পর্কে জানেন ও মানেন, তাদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। এ জন্য আরও সময় লাগবে এবং সীমান্তের দুই পাশের লেখক, সাংবাদিক, গবেষক ও উন্নয়নকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে পর্যটন বাড়াতেই হবে। আপনারা শিলংয়ে বেড়াতে যেতে পারেন, কাছেই। উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ কক্সবাজার সৈকতে বেড়াতে আসতে পারে।
=০=
সূত্র : দৈনিক সমকাল, প্রিন্ট সংস্করণ, প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০১৫ | আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০১৫, ১২:৪০:১৮
No comments:
Post a Comment