সৈয়দ ইবনে রহমত ::
দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের বিচ্ছিন্নতাবাদি রক্তক্ষয়ী আন্দোলন দমানোর লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তিটিকে এর দু’পক্ষ তথা জনসংহতি সমিতি এবং আওয়ামী লীগ সরকার শান্তি চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে জোর প্রচার চালায়। তাদের এই প্রচারে যুক্ত হয় তাদেরই অনুগত এবং সহমত পোষণকারী কতিপয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল।
অন্যদিকে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি (যদিও পরে ক্ষমতায় এসে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে) এবং সমমনা রাজনৈতিক দল, পার্বত্যবাসী বাঙালিসহ সারা দেশের সাধারণ জনগণ এই পার্বত্য চুক্তিকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে কালো চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে। এচুক্তি বাতিলের দাবিতে বিএনপি’র নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে অনুষ্ঠিত হয় দেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় লংমার্চ। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পার্বত্য চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করার পেছনে অনেক যৌক্তিক কারণ ছিল। চুক্তিটি করা হয়েছিল সংসদকে পাশ কাটিয়ে। তাই প্রথম থেকেই আশংকা ছিল চুক্তিতে এমন কিছু আছে যা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অবমাননাকর।
বাস্তবে হয়েছেও তাই। চুক্তি স্বাক্ষরের পর যখন তা প্রকাশ করা হলো তখন দেখাগেল চুক্তির ভূমিকাতে লেখা রয়েছে, “বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে পার্র্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নি¤েœ বর্ণিত চারিখন্ড (ক,খ,গ,ঘ) সম্বলিত চুক্তিতে উপনীত হইলেন।” ভূমিকাতে সুন্দর সুন্দর শব্দের ব্যঞ্জনায় ভরপুর থাকলেও চুক্তির প্রথম খন্ডের প্রথম ধারা থেকেই শুরু হয়েছে দেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানো।
চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ১ নং ধারায় বলা হয়েছে, “উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল' হিসাবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছে’’। এখানে লক্ষনীয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের কোন বিশেষ জেলা বা বিভাগ বলে ঘোষণা করা হয়নি, উল্লেখ করা হয়েছে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে। যা দেশের প্রচলিত প্রশাসনিক অবকাঠামোতে পড়ে না। ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হতে বাধ্য, হচ্ছেও তাই। তা ছাড়া জনসংহতি সমিতির মূল পরিকল্পনা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠা করা। তাদের মূল পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের প্রচলিত শাসন কাঠামোর বাইরে এই বিশেষ নামে বিশেষায়িত করেছে। যাতে চুক্তি করে অস্ত্র জমা দেওয়ার পরেও তারা প্রশাসনিক জটিলতার আড়ালে ‘স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে পারে।
বাংলাদেশে ৪৫টি উপজাতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি (পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী) উপজাতির লোক বসবাস করে। অর্থাৎ সারা দেশের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের এমন আহামরি কোন অবস্থান নেই যে তাদের জন্য সব কিছুই বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। নানা কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা’ দেশের অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। যা চুক্তির ভূমিকার সাথে সাংঘর্ষিক। ভূমিকার সাথে এমন সাংঘর্ষিক অনেক ধারা উপ-ধারাই পার্বত্য চুক্তিতে রয়েছে। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী পার্বত্য চুক্তিকে বিশ্লেষণ করেছেন ৫৩ (তিপ্পান্ন) খন্ডে, যা ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি সংবিধান স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব’ শিরোনামের বই আকারে প্রকাশ করেছেন। অনুসন্ধানী পাঠক পার্বত্য চুক্তির স্বরূপ বুঝতে চাইলে বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট স্টাডিজ ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত উপরোক্ত শিরোনামের বইটি পড়ে দেখতে পারেন। চুক্তির ভূমিকায় আরো একটি বিষয় লক্ষনীয় এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা”। ভূমিকায় উপর্যুক্ত কথাগুলোর সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। পার্বত্য চুক্তির অনেক ধারা-উপধারার মাধ্যমে জাতিগত বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নি¤েœ আলোচনা করা হলো-
রাজনৈতিক অধিকার : পার্বত্য চুক্তির ভূমিকায় সকল নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকারের কথা একই সাথে সমান গুরুত্ব দিয়ে বলা হলেও চুক্তির শুরু থেকেই পার্বত্যাঞ্চলের জনসাধারণকে উপজাতি এবং অ-উপজাতিÑএ দুটি বিশেষণে আখ্যায়িত করে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং,তনচ্যৈঙ্গ্যা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমী, চাক এবং খিয়াং এই ১১টি জনগোষ্ঠীকে। বাঙালি ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে সাওতাল, নেপালী, রোহিঙ্গা, গারো, মনিপুরি, কুকি, ভূটানী, আসামী, রিয়াং, সেন্দুজ। বাঙালিসহ এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সবাইকে দৃশ্যত ‘অ-উপজাতি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জন সংখ্যার অর্ধেকই বাঙালি। অন্যদিকে তাদের সাথে অ-উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে একত্রে বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, এখানকার ‘অ-উপজাতীয়’ জনসংখ্যা উপজাতিদের চাইতে অনেক বেশি। তার পরও এখানকার জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ শুধু মাত্র উপজাতিদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলেই সন্তু লারমা ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে অন্তবর্তকালীন আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এর দায়িত্বে আছেন প্রায় ১৬ বছর ধরে। আর কতকাল এই দায়িত্বে থাকবেন এটা তিনি আর সৃষ্টিকর্তা ছাড়া সম্ভবত আর কেউ জানেন না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় তৈরি করে সেখানে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের জন্য উপজাতীয়দেরকেই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে স্থায়ী বাসিন্দার শর্ত জুড়ে তাদের ভোটাধিকারকেই অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অন্যদিকে উপজাতিদের ভোটাধিকারের ব্যাপারে কোন শর্তারোপ না করে স্বেচ্ছাচারের সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে করে পার্শ্ববর্তী দেশের উপজাতীয়দের অবৈধভাবে বাংলাদেশে ভোটার হওয়ার আশংকা রয়েছে। জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় এবং ভোটাধিকারের উপরোক্ত অবস্থাগুলো বিবেচনা করে বলা যায় যে, পার্বত্য চুক্তির ভূমিকায় সকল নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার সমুন্নত রাখার কথা থাকলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বিপরীত। তাই এই অবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন সংবিধান স্বীকৃত সকল নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চত করা। অন্যথায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির আশা কাগজে কলমেই থেকে যাবে, বাস্তবে মুখ দেখবে না।
শিক্ষার অধিকার : মেডিকেল, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য সকল উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে ১৯৮৪ সাল থেকে।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর উপজাতীয় ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোটার সংখ্যা বৃদ্ধি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আমলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন থেকে প্রতি বছর ক্যাডেটসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর ৩২৫জন উপজাতীয় ছাত্র ছাত্রীকে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। নতুন স্থাপিত উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সাথে সাথে উপজাতি কোটা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি করা হচ্ছে। অন্যদিকে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র ছাত্রীদের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৩৩টি আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তাও আবার রাষ্ট্রীয় কোনো আগ্রহের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কোটা চালু হয়নি। এটা হয়েছে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র ছাত্রীদের আন্দোলনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের সহানুভূতির ফসল হিসেবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কোটা প্রবর্তনের পেছনে আরও যাদের অবদান উল্লেখযোগ্য তারা হলেন, খাগড়াছড়ির সাবেক সাংসদ ওয়াদুদ ভূঁইয়া এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সিন্ডিকেট সদস্য, আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক মুহাম্মদ ইউনুস। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলেই পার্বত্য বাঙালি ছাত্র ছাত্রীরা ভর্তির জন্য এই কোটা সুবিধা পেয়েছে। তবে ইতিপূর্বে ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয় সরকারই পার্বত্য বাঙালি ছাত্র ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেওয়ার জন্য সকল প্রতিষ্ঠানে কোটা চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তাদের প্রতিশ্রুতি বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি।
উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এ কোটা বৈষম্যের কারণে পার্বত্যাঞ্চলে আজ উপজাতি এবং বাঙালিদের মধ্যে বিশাল বৈষম্য তৈরি হয়েছে। একটা পরিসংখ্যান দিলেই ব্যাপারটি স্পস্ট হবে। যেমন ২০০৫ সালের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, খাগড়াছড়ি জেলার ৪ জন নাগরিক সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, যাদের সবাই উপজাতীয়। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ব বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন ৬ জন। এর মধ্যে একজন বাঙালি এবং অপর ৫ জন উপজাতীয়। ম্যাজিস্ট্রেট ৫ জন এবং প্রত্যেকেই উপজাতীয়। ডাক্তার আছেন ৩৫ জন, সবাই উপজাতীয়। ইঞ্জিনিয়ার আছেন ১২ জন, যাদের সবাই উপজাতীয়। উচ্চপদস্থ ২ জন পুলিশ অফিসার আছেন তারাও উপজাতীয়। অর্থাৎ খাগড়াছড়ি জেলার নাগরিকদের মধ্যে উচ্চপদস্থ ৬৪ জন কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র একজন বাঙালি আর বাকি ৬৩ জনই উপজাতীয়। অতএব, উচ্চ শিক্ষায় পার্বত্য বাঙালিদের বঞ্চিত করে শুধু মাত্র উপজাতীয়দের জন্য কোটা চালু করে কত মারাত্মক বৈষম্য তৈরি করেছে এটা নিশ্চয় আর ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পার্বত্য চুক্তির ভূমিকাতে সকল নাগরিকের শিক্ষার অধিকার সমুন্নত রাখার কথা থাকলেও সেটা যে কত ভয়ংকর মিথ্যা তা আমাদের সরকার আশা করি বুঝতে সক্ষম হবে। সেই সাথে সকল নাগরিকের শিক্ষার সুযোগ যাতে সমানভাবেই দেয়া যায় সে লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ নিবে।
অর্থনৈতিক অধিকার : পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উপজাতীয়দের সকল প্রকার লেনদেন আয়কর মুক্ত। পার্বত্য এলাকায় যেসব উন্নয়নমূলক প্রকল্পের ব্যয় বরাদ্দ দু’লক্ষ টাকার মধ্যে সেগুলোর ঠিকাদারী সম্পূর্ণরূপে উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত। দু’লাখ টাকার ঊর্ধ্বে বরাদ্দকৃত প্রকল্পের ১০% উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত। বাকি ৯০% ঠিকাদারির সিংহভাগ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উপজাতীয়রাই দখল করে নেয়। কারণ তাদের আয়কর দিতে হয় না বলে তারা বাঙালিদের চাইতে কম দরে কাজ করার সুযোগ পায়। উপজাতীয়রা ব্যাংক ঋণ নিলে তাদের সুদ দিতে হয় শতকরা মাত্র ৫ টাকা। আর বাঙালিদের সুদ দিতে হয় সারা দেশবাসীর মতই শতকরা ১৬ টাকা বা তার চেয়েও বেশি। সরকারিভাবে গৃহীত এ ধরনের ভ্রান্তনীতির কারণে পার্বত্যাঞ্চলের বাঙালিরা উপজাতীয়দের তুলনায় প্রতিনিয়তই পিছিয়ে পড়ছে। দিনে দিনে উপজাতীয়রা এলিট শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছে আর অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হতে হতে বাঙালিরা আজ অবহেলিত এবং উপজাতীয়দের অনুগত শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। সরকারিভাবে এ ধরনের জাতিগত বৈষম্য তৈরি কখনোই কাম্য হতে পাওে না। আর এমন বৈষম্য নীতি কোন অঞ্চলের শান্তির জন্যও সহায়ক নয়। তাই এসব বৈষম্যের অবসান করে পার্বত্যাঞ্চলে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করার সময় এখনই।
ভূমির অধিকার : চুক্তি পূর্ব বিশৃঙ্খল অবস্থায় যেসব উপজাতীয় নাগরিক ভারতে আশ্রয় গ্রহণকরেছিল তাদেরকে ফিরিয়ে এনে ২০দফা প্যাকেজ সুযোগ সুবিধা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এভাবে ৬০ হাজারেরও বেশি উপজাতীয় জনগণ বর্তমানে পুনর্বাসিত হয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। অন্যদিকে ১৯৮৬ সাল থেকে ২৮ হাজারের বেশি বাঙালি পরিবারকে অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে গুচ্ছ গ্রামে এনে কার্যত বন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছে। গুচ্ছ গ্রামগুলোতে পরিবার প্রতি একটি মাত্র ঘর তোলার জায়গা আর মাসিক ৮৬ কেজি চাল অথবা গম তাদের একমাত্র অবলম্বন। ২৯ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এসব গুচ্ছ গ্রামের এক একটি পরিবার ভেঙ্গে বর্তমানে ২টি, ৩টি বা তার চেয়েও বেশি পরিবারে বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু বাড়েনি তাদের ঘর তোলার জায়গা, মাসিক রেশনের পরিমাণও বাড়ানো হয়নি। তাছাড়া গুচ্ছ গ্রামগুলোতে সেনিটেশন ব্যবস্থাও নেই। নেই ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুলÑকলেজ।
চাষাবাদের জমিও তাদের নেই। ফলে তারা একমাত্র মাসিক ৮৬ কেজি রেশনের উপর নির্ভরশীল হয়ে কোনো রকমে জীবন ধারণ করছে। মাÑবাবা, ছেলেÑমেয়ে, ছেলের বউ, মেয়ের জামাই, হাঁসÑমুরগী, গরুÑছাগলসহ একই ঘরে গাদাগাঁদি করে মানবেতর জীবনযাপন করছে গুচ্ছ গ্রামবাসী বাঙালি পরিবারগুলো। অথচ তাদের কবুলিয়ত ভুক্ত জমিÑজমাগুলো দুস্কৃতিকারী উপজাতীয়রা দখল করছে নানা কৌশলে। কখনও বাঙালিদের জমিতে রাতারাতি কেয়াং নির্মাণ করে আবার কখনও চাষ করে দখল করছে বাঙালিদের জমি। সব কিছু দেখেও আমাদের সরকার এবং প্রশাসন নির্বিকার। তাদের যেন কিছুই করার নেই। বাঙালিরা গুচ্ছগ্রামে আবদ্ধ হয়ে যুগ যুগ ধরে বসবাস করতে থাকবে এটাই যেন স্বাভাবিক। কিন্তু এ অমানবিক অবস্থা দীর্ঘ দিন চলতে পারে না। আর চললেও সরকার এবং উপজাতি কারো জন্যই তা মঙ্গলজনক হবে না। তা ছাড়া রেশন বাবদ প্রতিমাসে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এসব বিবেচনা করে গুচ্ছগ্রামবাসী বাঙালিদেরকে তাদের কবুলিয়ত ভুক্ত জমিতে পুনর্বাসন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আশা করি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
পার্বত্য চুক্তির ভূমিকার সাথে এর ধারা উপধারা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক অবস্থার মধ্যে সাংঘর্ষিক আরও অনেক বিষয় রয়েছে। আর এসব কিছুর ফলেই পার্বত্য চুক্তিকে শুরু থেকে সচেতন দেশবাসী মেনে নিতে পারেনি। ভবিষ্যতেও মেনে নেয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে গত ১৭ বছরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সরকার চুক্তির বিতর্কিত ধারা উপধারাগুলি নতুনভাবে বিবেচনা করতে পারে। এতে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয় সারা দেশই উপকৃত হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
sayedibnrahmat@gmail.com
No comments:
Post a Comment