সৈয়দ ইবনে রহমত : পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ১৮ বছর পূর্তিতেও তথা দেড় যুগ পরেও কাঙ্ক্ষিত শান্তি আসেনি, বরং চতুর্মুখী সঙ্কট ঘনিয়ে আসছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন চক্র কাজ করছে বাংলাদেশের এক দশমাংশ এই পার্বত্যাঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফায়দা লুটতে। তাছাড়া, চুক্তির কতটি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়েও চলছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব স্বাক্ষরকারী পক্ষদ্বয়ের মধ্যে। সরকারি ভাষ্য মতে,
চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৯টি ধারার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। অন্যদিকে পার্বত্য জনসংহতি সমিতির দাবি, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। অর্থাৎ চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশই অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। আর চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন হওয়া না হওয়া নিয়েও রয়েছে উভয় পক্ষের মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং মতবিরোধ।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের বিচ্ছিন্নতাবাদি রক্তক্ষয়ী আন্দোলন দমানোর লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তিকে জনসংহতি সমিতি এবং আওয়ামী লীগ শান্তিচুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে জোর প্রচার চালায়। অন্যদিকে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি (যদিও পরে ক্ষমতায় এসে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে) এবং সমমনা রাজনৈতিক দল, পার্বত্যবাসী বাঙালিসহ সারা দেশের সাধারণ জনগণ এই পার্বত্য চুক্তিকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে কালো চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে। এচুক্তি বাতিলের দাবিতে বিএনপি’র নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে অনুষ্ঠিত হয় দেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় লংমার্চ। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পার্বত্য চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করার পেছনে অনেক যৌক্তিক কারণ ছিল। চুক্তিটি করা হয়েছিল সংসদকে পাশ কাটিয়ে। তাই প্রথম থেকেই আশঙ্কা ছিল চুক্তিতে এমন কিছু আছে যা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অবমাননাকর।
বাস্তবে হয়েছেও তাই। চুক্তি স্বাক্ষরের পর যখন তা প্রকাশ করা হলো, তখন দেখা গেল চুক্তির ভূমিকাতে লেখা রয়েছে, “বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিম্নে বর্ণিত চারিখন্ড (ক,খ,গ,ঘ) সম্বলিত চুক্তিতে উপনীত হইলেন।” ভূমিকাতে সুন্দর সুন্দর শব্দের ব্যঞ্জনায় ভরপুর থাকলেও চুক্তির প্রথম খন্ডের প্রথম ধারা থেকেই শুরু হয়েছে দেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন। আর এ কারণেই পার্বত্য চুক্তি সংক্রান্ত এক মামলার রায়ে হাইকোর্ট এই চুক্তির অনেক কিছুকেই অবৈধ বলে রায় দিয়েছে, যা বর্তমানে আপিল বিভাগের বিবেচনাধীন আছে।
চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ১ নং ধারায় বলা হয়েছে, “উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসাবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছে’’। এখানে লক্ষনীয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের কোন বিশেষ জেলা বা বিভাগ বলে ঘোষণা করা হয়নি, উল্লেখ করা হয়েছে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে। যা দেশের প্রচলিত প্রশাসনিক অবকাঠামোতে পড়ে না। ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য, হচ্ছেও তাই। তা ছাড়া জনসংহতি সমিতির মূল পরিকল্পনা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠা করা। তাদের মূল পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের প্রচলিত শাসন কাঠামোর বাইরে এই বিশেষ নামে বিশেষায়িত করেছে। যাতে চুক্তি করে অস্ত্র জমা দেওয়ার পরেও তারা প্রশাসনিক জটিলতার আড়ালে ‘স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে পারে। এখন আসলে তারা সেটাই করছে।
চুক্তির নেতিবাচক কিছু ফল : পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর বেশ কিছু নেতিবাচক ফল দেখা দিয়েছে যা আসলে কারো কাছেই কাম্য ছিল না। প্রথমত চুক্তির প্রতিটি ধারা এবং উপ-ধারায় পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের অধিকার বঞ্চিত করা হয়েছে। যার ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিকক, শিক্ষা, চাকরি, ভূমির মালিকানা এবং রাজনৈতিকসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতিগত বৈষম্য তৈরি হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। দ্বিতীয়ত, পার্বত্যাঞ্চলে আর অস্ত্রের ঝনঝনানি থাকবে না এটাই ছিল শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে মূল প্রত্যাশা। আরও আশা করা হয়েছিল যে, উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি তাদের পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করবেন। আর সে অনুযায়ী তারা দেশের অখন্ডতায় বিশ্বাসীয় হয়ে সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গঠনে ব্রতী হবেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের অখন্ডতা রক্ষায় তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আনুগত্য দেখাতে কার্যত ব্যর্থ।
শান্তিু চুক্তি স্বাক্ষরের আগের তুলনায় কিছুটা শান্তি বিরাজ করলেও প্রকৃত অর্থে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যার কারণে পার্বত্য জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমাকে এখনো বলতে হচ্ছে যে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আমি নিজেই নিরাপদ নই’। বিশেষ করে, শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর পর গঠিত ইউপিডিএফ এবং পরবর্তী সময়ে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জেএসএস থেকে বেরিয়ে যাওয়া সংস্কারপন্থী জেএসএস-এর মধ্যে পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ত্রি-মুখী লড়াইয়ে খুন, অপহরণে অতিষ্ঠ পার্বত্যবাসী। কারো জীবনেই যেন নিরাপত্তা নেই। আবার পরস্পরকে দমন ও মোকাবিলা করার জন্য এসব সংগঠন প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করছে অত্যাধুনিক সব মারনাস্ত্র। ধারণা করা যায়, শুধু পরস্পরকে মোকাবেলা করার জন্যই নয়, বরং এসব অস্ত্র তারা সংগ্রহ করছে, তাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ‘স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড’ বাস্তবায়নকে সামনে রেখেই। যা সাম্প্রতিক সময়ে সেনাবাহিনীর হাতে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের নমুনা দেখলেই বোঝা যায়। তাছাড়া, এসব অস্ত্র পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত নিরীহ বাঙালিসহ সেনাবাহিনী, বিজিবির বিরুদ্ধে ব্যবহার করার ঘটনাও ঘটছে।
অন্যদিকে পার্বত্য চুক্তির ফলে সৃষ্ট আঞ্চলিক পরিষদে থেকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন তৎপরতার অভিযোগ উঠছে চুক্তি স্বাক্ষরকারী জেএসএসের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া আরাকান আর্মির নেতা রেনিন সোয়ের সাথে জেএসএস ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের সখ্যতার প্রমাণ এই ধারণাকেই পাকা করছে। ধারণা করা হচ্ছে, জেএসএস পার্শ্ববর্তী দেশের বিচ্চিন্নতাবাদীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে নতুন কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে। আর গত ১ মে ২০১৫ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনের নামে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকেই এগুচ্ছে তারা। সিএচটি কমিশনসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও এবং অন্যান্য সংগঠনও এসবে মদদ যোগাচ্ছে। খ্রিস্টান মিশনারিরাও পার্বত্যাঞ্চলকে নানাভাবে অস্তিতিশীল করার পেছনে ইন্দন যোগাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। এমনকি অস্ত্রসহ খ্রিস্টান পাদ্রী গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটেছে।
চুক্তির ইতিবাচক কিছু ফল : এটা সত্য যে, চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বের তুলনায় বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম দৃশ্যত অনেকটাই শান্ত, যদিও এর গভীরতা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে। আর এই শান্ত পরিবেশের কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিশেষ করে ব্যাপকহারে রাস্তা নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, পর্যটনের বিকাশসহ বিভিন্ন আঙ্গিকে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এবং হচ্ছে। আর শিক্ষাসহ বিভিন্ন উন্নয় কর্মকাণ্ডে সেনাবাহিনীরও যে ব্যাপক ভূমিকা আছে তা সন্তু লারমাও স্বীকার করেন, যদিও তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন চলছে বলে সব সময় অভিযোগ করে থাকেন।
চতুর্মুখী সঙ্কটের পার্বত্য চট্টগ্রাম : পার্বত্য চট্টগ্রামে এককভাবে সবচেয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালিদের বৈষম্যের শিকার হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি বড় ধরনের সঙ্কট। সরকারের যে কোন উদ্যোগের বিরুদ্ধে জেএসএস-এর অবস্থান গ্রহণ পার্বত্য সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে বরং পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করছে। অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে মায়ানমার এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অনুপ্রবেশ, খ্রিস্টান মিশনারিদের বাড়াবাড়ি, সিএইচটি কমিশনসহ বিভিন্ন এনজিও এবং অন্যান্য সংগঠনের অতিরিক্ত খবরদারির কারণে আজ চতুর্মুখী সঙ্কটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। তার ওপর চুক্তির বাইরেও জেএসএসের নিত্যনতুন চাহিদা (যেমন চুক্তিতে বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সরিয়ে নেওয়ার কথা না থাকলেও তারা এখন সে দাবি করছে। তাছাড়া, চুক্তিতে উপজাতি দাবি করলেও এখন তারা নিজেদের আদিবাসী দাবি করছে) সঙ্কটকে আরও ঘনিভূত করছে।
এসব সঙ্কট মোকাবিলা করে পার্বত্য সমস্যার সমাধান করতে হলে বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে। রাষ্ট্রীয় নীতিমালা তথা সংবিধানের মধ্যেই খুঁজতে হবে সকল সমস্যার সমাধান। তা নাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান শুধু মুখের বুলি হিসেবেই থেকে যাবে, বাস্তব রূপ পাবে না।
No comments:
Post a Comment